রাগ হচ্ছে, মন খারাপ লাগছে, তীব্র ঘৃণা হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধ চাই কথাটা বলতে পারছি না

দুপুর সাড়ে তিনটে চারটে । অথচ একটুও আলো নেই। ঠাণ্ডা স্যাঁতস্যাতে ভেজা ভেজা একটা রাস্তা। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মানুষের শরীর। যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল গাড়ির টুকরো সেভাবেই বোধহয় ছিটকে ছিটকে পড়ে ছিল পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া কিছু মানুষের শরীর। যতবার পুলওয়ামার ছবিটা দেখেছি শিউরে উঠেছি। কী কম দাম জীবনের !! যখন এতজন জওয়ানকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিল কনভয়টা তখন ভিতরে বসে থাকা মানুষগুলি একবারও ভেবেছিল যে কিছুক্ষণর মধ্যেই স্রেফ 'নেই' হয়ে যাবেন তাঁরা। এতটাই নেই যে তাঁদের দেহ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।


রাগ হচ্ছে, মন খারাপ লাগছে, তীব্র ঘৃণা হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধ চাই কথাটা বলতে পারছি না। সত্যি বলতে পারছি না। কাল থেকে ফেসবুক যুদ্ধের পোস্টে দেখছি উপচে পড়ছে। যাঁরা বলছে যুদ্ধ চাই, তাঁরাও যুদ্ধে যাবে না, আমিও যাব না। যুদ্ধে আবার সেই তাঁরাই যাবে কাল যাঁদের সহকর্মী বন্ধুদের রক্তে পুলওয়ামা ভেসে গেছে। আমার কী ? আমি বাড়িতে বসে থাকব, টিভি দেখে আমার গায়ের রক্ত খলবল করবে, পাকিস্তানকে উড়িয়ে দেওয়া কত সহজ আমরা চাইলেই পারি জাতীয় গরমাগরম লেকচার ঝাড়ব নয়ত খানিকক্ষণ এই সব দেখার পর 'বাবা আর দেখে যায় না' বলে উঠে যাব অথবা চ্যানেল ঘুরিয়ে সিরিয়াল দেখব। তারপর ফেসবুকে গরম গরম স্ট্যাটাস দেব। বলব 'সেনাদের জন্য আজ বারান্দায় দুটো মোমবাতি জ্বালান আর আপনার ডিপিটা কালো করে দিন'। ব্যস আমার দায়িত্ব শেষ।


কাল সকাল থেকে আবার সবকিছু ভুলে যাব। ভুলে তো যাবই যুদ্ধটা যে আমার গায়ে লাগে না !! আমার বাড়ির কেউ যুদ্ধে গেছে ? যায় নি তো। যাওয়ার সাহসও নেই আমার। আমার বাড়ির লোক বাড়ি ফিরতে দেরি করলে আমি ঘর-বার করে মরি। আমার ভালবাসার মানুষের গায়ে একটা আঁচড় লাগলে আমি পাগল হয়ে যাই। ওঁরা দিনের পর দিন বাড়ি ফেরে না। ফিরতে পারবে কিনা তাও জানে না। বিরুদ্ধ যুক্তি অবশ্য আমার সাজানো। আমি কি সরকারের পোষা সৈন্য না দাবার বোড়ে যে যুদ্ধক্ষেত্রে মরতে যাব !! ওঁদের কাজই তো যুদ্ধ করা। হয় মারা নয়ত মরে যাওয়া। ওরাও কি মরতে যায় ? কে চায় মরে যেতে ? ঘৃণ্য রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বলিকে শহীদ বলি আমরা। ওরা যখন বাড়িতে ফোন করে, বলে না 'যে বাবা দেখো একদিন মরে গিয়ে মুখ উজ্জ্বল করব তোমার।' বরং  বলে, 'বাবা এবার বাড়িতে আসব। কতদিন দেখিনা তোমাদের। কিছু টাকা আনতে পারব এবার। বোনটার বিয়ে দেব। একটা পাকা ঘরের শখ ছিল না তোমার ? সেটা করে দেব।' তুচ্ছ সাধ, সাধারণ স্বপ্ন। অতিমানব নয়ত ওঁরা। মানুষই আমাদের মতো।


যদি বলা হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধটা শুধু সীমান্তে হবে না। ঘরে ঢুকে আসবে সেটা, পরিবারের একজনকে যুদ্ধে যেতেই হবে। পাকিস্তান তো আর ছেড়ে দেবে না। সেও নামবে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। সব কটা দেশের হাতে মারণাস্ত্র আছে। আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুধু বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাবে। আমাদের অর্থনীতি ধসে যাবে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে হুহু করে...তখন? বুকে হাত দিয়ে তখনও বলতে পারব তো যুদ্ধ চাই ? পারব না। আমরা জানি যুদ্ধটা বোড়েদের ওপর দিয়ে যাবে, ওই জন্যই মাইনে পায় ওঁরা। তাই আমাদের এত যুদ্ধ যুদ্ধ হুঙ্কার।


যুদ্ধ হলে পাকিস্তানের হারানোর কিছু নেই। যুদ্ধবাজ, দাঙ্গাবাজ দেশ একটা। ওদের না আছে স্বাস্থ্য না শিক্ষা না উন্নয়ন। আমাদের অনেক কিছু আছে হারানোর মত। আমরা প্রতিদিন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছি। আমাদের ভবিষ্যত আছে। পাকিস্তানের নেই।যুদ্ধ যদি সমস্যার সমাধান হত কার্গিলের পর পাকিস্তানের কোমড় ভেঙে যাওয়ার কথা। হয়নি তো সেটা।


যুদ্ধ চাই না। কিন্ত প্রতিকার চাই। এত মৃত্যু বিফলে না যায় যেন। পঙ্গু হয়ে যাক দেশটা অর্থনৈতিকভাবে, বিছিন্ন হোক কূটনৈতিকভাবে। আমাদের দেশের আর এক ফোঁটা রক্ত যেন না ঝরে পাকিস্তানের জন্য।


সারা দেশের মানুষ এক হয়ে এটাই যেন চায়।


------সায়ন্তনী সেনগুপ্ত

Post a Comment

Previous Post Next Post